ইতিহাস (History):
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (International Space Station বা ISS) হলো একটি কৃত্রিম উপগ্রহ যা পৃথিবীর কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে। ১৯৮৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান প্রথম এই মহাকাশ স্টেশনের প্রস্তাব দেন। ১৯৯৮ সালের ২০শে নভেম্বর রাশিয়া প্রথম মডিউলটি উৎক্ষেপণ করে। এরপর নাসা (NASA), রাশিয়ান মহাকাশ সংস্থা রোসকসমস (Roscosmos), ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ESA), জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (JAXA), এবং কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি (CSA) এর সহযোগিতায় ISS এর বিভিন্ন অংশ তৈরি ও সংযোজন করা হয়। বর্তমানে ISS হলো বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য একাধিক দেশের যৌথ প্রচেষ্টার ফলাফল।
অবস্থান (Location):
ISS পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে (Low Earth Orbit - LEO) প্রায় ৪০০ কিলোমিটার (২৫০ মাইল) উচ্চতায় অবস্থান করে। এটি পৃথিবীর চারপাশে প্রায় প্রতি ৯০ মিনিটে একবার পরিভ্রমণ করে, অর্থাৎ প্রতি দিন প্রায় ১৬ বার পৃথিবীর চারপাশ প্রদক্ষিণ করে।
প্রক্রিয়া (Mechanism):
ISS একটি মডুলার মহাকাশ স্টেশন, যা বিভিন্ন মডিউল (module) বা অংশ দ্বারা সংযুক্ত। প্রতিটি মডিউল একটি নির্দিষ্ট কাজের জন্য তৈরি করা হয়েছে, যেমন বাসস্থান, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, শক্তি উৎপাদন ইত্যাদি। মহাকাশ স্টেশনটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রধানত সৌর প্যানেল ব্যবহার করে, যা সূর্যের আলোক থেকে বিদ্যুৎ সঞ্চয় করে। এই বিদ্যুৎ দিয়ে মহাকাশ স্টেশনের বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এবং জীবনধারণের সিস্টেম চালানো হয়। এছাড়াও, মহাকাশ স্টেশনটি নিয়মিত রকেট বা মহাকাশযান দ্বারা রক্ষণাবেক্ষণ ও রিফুয়েল করা হয়।
পদার্থবিজ্ঞানের নীতি (Principle of Physics):
ISS পদার্থবিজ্ঞানের বেশ কিছু মৌলিক নীতির উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়:
মহাকর্ষীয় বল (Gravity): ISS পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করছে, যেখানে মাইক্রোগ্র্যাভিটি (microgravity) বা ক্ষুদ্র মহাকর্ষীয় বল রয়েছে। এই পরিবেশে মহাকাশচারীরা প্রায় ভাসমান অবস্থায় থাকেন।
কেন্দ্রাভিমুখ বল (Centripetal Force): ISS পৃথিবীর চারপাশে উচ্চ গতিতে ঘোরে, কিন্তু মহাকর্ষীয় টানের কারণে এটি পৃথিবী থেকে দূরে চলে যায় না। এই কেন্দ্রাভিমুখ বলের কারণে ISS তার কক্ষপথে থাকে।
নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্র (Newton’s Third Law of Motion): মহাকাশ স্টেশনে যখন রকেটের মাধ্যমে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়, তখন রকেটের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি স্টেশনটিকে তার কক্ষপথে স্থিতিশীল রাখে।
কাঠামো (Structure of ISS):
ISS একটি বিশালাকার কাঠামো যা প্রায় একটি ফুটবল মাঠের সমান। এর প্রধান অংশগুলি হলো:
প্রেসারাইজড মডিউলস (Pressurized Modules): এগুলি মহাকাশচারীদের বসবাসের জন্য এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য ব্যবহৃত হয়। যেমন, জারিয়া (Zarya) মডিউল এবং ডেস্টিনি (Destiny) ল্যাবরেটরি মডিউল।
ট্রাস সিস্টেম (Truss System): ISS এর কেন্দ্রীয় অংশ যা মডিউলগুলিকে সংযুক্ত করে এবং সৌর প্যানেলগুলোকে ধরে রাখে।
সৌর প্যানেল (Solar Panels): এই প্যানেলগুলো সৌরশক্তি গ্রহণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। ISS এর সৌর প্যানেলগুলো প্রায় ২,৫০০ বর্গমিটার জায়গা দখল করে।
ডকিং পোর্ট (Docking Ports): মহাকাশযানগুলির জন্য বিভিন্ন ডকিং পোর্ট রয়েছে যেখানে তারা এসে সংযুক্ত হতে পারে।
জ্বালানির ব্যবস্থা (Fuel Mechanism):
ISS এর জন্য সরাসরি কোনো জ্বালানি ব্যবহার করা হয় না কারণ এটি একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে এবং মাধ্যাকর্ষণ এবং গতি এটিকে স্থিতিশীল রাখে। তবে, ISS এর অরবিট সংশোধন এবং অবস্থান ঠিক রাখার জন্য occasional boosters ব্যবহৃত হয়, যা সাধারণত প্রোগ্রেস স্পেসক্রাফট বা অন্যান্য সরবরাহকারী রকেট দ্বারা পরিচালিত হয়। এতে প্রধানত কেমিক্যাল প্রপালশন ব্যবহার করা হয়।
অংশগ্রহণকারী দেশগুলো (Participating Countries):
ISS একটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রকল্প, যেখানে প্রধান পাঁচটি মহাকাশ সংস্থা অংশগ্রহণ করেছে:
- নাসা (NASA) - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
- রোসকসমস (Roscosmos) - রাশিয়া।
- ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ESA) - ইউরোপের বিভিন্ন দেশ।
- জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (JAXA) - জাপান।
- কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি (CSA) - কানাডা।
গবেষণা (Researches Conducted):
ISS-এ বিভিন্ন ধরনের গবেষণা পরিচালিত হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
- জৈবপ্রযুক্তি ও জীববিজ্ঞান গবেষণা: মাইক্রোগ্রাভিটির প্রভাব নিয়ে গবেষণা।
- পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন: নতুন পদার্থ এবং রাসায়নিকের গঠনের প্রভাব।
- মেডিকেল গবেষণা: মহাকাশে মানুষের শারীরিক পরিবর্তনের ওপর গবেষণা।
- পরিবেশ সংক্রান্ত গবেষণা: পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এবং আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ।
- উদ্ভিদবিজ্ঞান গবেষণা: মহাকাশে খাদ্য উৎপাদনের সম্ভাবনা।
অর্থায়ন (Funding):
ISS এর তহবিল প্রধানত অংশীদার দেশগুলোর মহাকাশ সংস্থাগুলির মাধ্যমে আসে। নাসা ISS-এর সর্বাধিক অংশের জন্য তহবিল যোগায়, এবং অন্যান্য দেশগুলি তাদের নিজস্ব মডিউল ও যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে। সম্পূর্ণ প্রকল্পটির ব্যয় কয়েকশো বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা (Future Plans):
ISS-এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩০ সাল পর্যন্ত এটি চালু থাকবে। ভবিষ্যতে মহাকাশে বাণিজ্যিক স্টেশন তৈরি করা, চাঁদ ও মঙ্গলের অভিযানের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া ISS এর গবেষণার মূল লক্ষ্য। এছাড়াও, অনেক দেশ চাঁদের কক্ষপথে নতুন স্পেস স্টেশন গড়ার পরিকল্পনা করছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন