এস্ট্রো-কেমিস্ট্রিঃ পুরো আকাশই একটি বিশাল টেস্ট টিউব





এস্ট্রো-কেমিস্ট্রি (Astrochemistry) হল এমন একটি শাখা, যেখানে মহাবিশ্বের বিভিন্ন স্থানে গ্যাস এবং ধূলিকণার রাসায়নিক গঠন, বৈশিষ্ট্য এবং বিক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করা হয়। এই শাস্ত্রটি মূলত মহাকাশে থাকা গ্যাসীয় এবং কঠিন পদার্থের সঙ্গে যুক্ত রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলোকে বিশ্লেষণ করে, যা আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে নতুন ধারণা দেয়।

মহাবিশ্ব একটি বিশাল টেস্ট টিউব

আমরা যখন আকাশের দিকে তাকাই, তখন তারকাখচিত রাতের আকাশে ফাঁকা স্থানগুলি দেখতে পাই, কিন্তু আসলেই সেখানে কোনো ফাঁকা জায়গা নেই। আসলে, এই স্থানগুলো গ্যাস দিয়ে পূর্ণ। সেন্টিমিটার প্রতি গড়ে ১০০ থেকে ১০০০টি মৌলিক কণা বিদ্যমান। তার মানে, ফাঁকা বলে যেটাকে মনে হচ্ছে, তা আসলে পাতলা গ্যাসের আস্তরণ।

এই গ্যাসীয় আস্তরণের মধ্যে প্রধান উপাদান হলো হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম, যাদের অংশ যথাক্রমে ৯২% এবং ৮%। এছাড়া, খুবই সামান্য পরিমাণে অন্যান্য মৌল যেমন অক্সিজেন, কার্বন, নাইট্রোজেনও বিদ্যমান। এই অন্যান্য মৌলগুলোই মহাকাশে জীবনের সম্ভাবনা এবং রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলোর জটিলতা সম্পর্কে ধারনা দেয়।

গ্যাসের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য

মহাকাশের এই গ্যাসের মধ্যে ১৮০টি আলাদা রাসায়নিক যৌগ এখন পর্যন্ত মাইক্রোওয়েভ স্পেকট্রার মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়েছে। মৌলগুলো যখন তাদের রাসায়নিক বন্ধনের চারপাশে ঘুরতে থাকে, তখন তারা শক্তি উৎপন্ন করে এবং তাদের ইলেকট্রনগুলি উচ্চ শক্তিস্তরে যেতে সক্ষম হয়, যা মাইক্রোওয়েভ স্পেকট্রার দ্বারা শনাক্ত করা যায়।

মহাবিশ্বে রাসায়নিক বিক্রিয়া

দুইটি কারণে এস্ট্রো-কেমিস্ট্রির গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। প্রথমত, এই বিক্রিয়াগুলো প্রাচীন সময়ে প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে ধারণা দেয়। দ্বিতীয়ত, মহাকাশে যে রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো ঘটে, সেগুলো পৃথিবীতে কল্পনা করাও কঠিন। মহাবিশ্বে এমন সব জটিল বিক্রিয়া ঘটে যা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। যেমন, নতুন বিক্রিয়াগুলো এমনভাবে এক অংশ থেকে অন্য অংশে যায়, যা আগে কখনও দেখা যায়নি।

আটাকামা লার্জ মিলিমিটার/সাবমিলিমিটার অ্যারে (আলমা) টেলিস্কোপ

আলমা (ALMA) টেলিস্কোপ, যা চিলির আটাকামা মরুভূমিতে অবস্থিত, পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপগুলির মধ্যে একটি। এই টেলিস্কোপ মহাকাশে দূরবর্তী ছায়াপথ ও নক্ষত্রকে পর্যবেক্ষণ করতে এবং সেখানকার রাসায়নিক উপাদানগুলোর গঠন প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করতে ব্যবহৃত হয়। ৬৬টি রেডিও ডিশ বিশিষ্ট এই টেলিস্কোপটি বিজ্ঞানীদের মহাকাশের আরও জটিল রাসায়নিক বিক্রিয়া পর্যবেক্ষণের সুযোগ দেয়।

আলমা টেলিস্কোপের সাহায্যে বিজ্ঞানীরা জটিল যৌগ যেমন গ্লাইকোলেলডিহাইড এবং অ্যাসিটোন শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। বিজ্ঞানীরা আরও আশা করছেন যে ভবিষ্যতে মহাকাশে সরল শর্করা এবং জৈব এসিড খুঁজে পাওয়া যাবে। যদি এ ধরনের যৌগগুলি পাওয়া যায়, তবে আমাদের পৃথিবীর বাইরে জীবনের অস্তিত্ব থাকার ধারণাটি আরও জোরালো হবে।

মহাকাশে নতুন রাসায়নিক প্রক্রিয়া

এস্ট্রো-কেমিস্ট্রি এমন এক শাখা যেখানে মহাকাশের নতুন রাসায়নিক প্রক্রিয়া আবিষ্কার করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মিথাইল ফরম্যাট নামে একটি যৌগের উৎপত্তি মহাকাশে নতুন উপায়ে ঘটে। পৃথিবীতে মিথাইল ফরম্যাট সাধারণত মিথানল এবং ফরমিক এসিডের বিক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপন্ন হয়। কিন্তু মহাকাশে, এই যৌগটি অস্থায়ী জটিল যৌগ এবং হাইড্রোজেনের বিক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হয়। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যা আগে কখনও পৃথিবীতে দেখা যায়নি।

মহাকাশ: একটি বিশাল রাসায়নিক পরীক্ষাগার

মহাকাশকে একটি বিশাল রাসায়নিক পরীক্ষাগার বা টেস্ট টিউব বলা যেতে পারে। মহাবিশ্বের অজানা রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলো আমাদেরকে নতুন জ্ঞানের সন্ধান দেয়। এস্ট্রো-কেমিস্টরা এই গবেষণা দ্বারা পৃথিবীতে রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলোর ধারণাকে আরও উন্নত করতে সক্ষম হচ্ছেন।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন