প্রাণের উদ্ভব এবং প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাসায়নিক যৌগগুলোর গঠন ও বিকাশ নিয়ে আলোচনা করার বিজ্ঞানকে আমরা এস্ট্রো-কেমিস্ট্রি বলি। এটি এমন একটি বিজ্ঞান যা জীববিজ্ঞান এবং রসায়নের মধ্যকার সেতুবন্ধন তৈরি করে, বিশেষত মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থায় জীবনের সৃষ্টির প্রশ্ন নিয়ে। এই বিজ্ঞান জীবরসায়নের মাধ্যমে প্রাণের শুরু থেকে প্রাণ রসায়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো নিয়ে বিশদ আলোচনা করে। আর এর অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো অ্যামিনো এসিড।
অ্যামিনো এসিড হচ্ছে এমন এক ধরনের জৈব যৌগ, যা প্রোটিন তৈরির মূল উপাদান হিসেবে কাজ করে। প্রোটিন মানুষের দেহের প্রায় প্রতিটি কোষের অংশ এবং কার্যকরী কাজে অবদান রাখে। জীবনধারণের জন্য প্রোটিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রোটিন গঠিত হয় অ্যামিনো এসিডের পলিমার শৃঙ্খল থেকে।
প্রোটিন তৈরির মূল ধাপ হলো জীন থেকে সঠিক ক্রমে আলফা অ্যামিনো এসিডদের পেপটাইড বন্ধনের মাধ্যমে একত্রিত করা। এর ফলে তৈরি হয় পলিপেপটাইড শৃঙ্খল, যা যথাযথভাবে ভাঁজ হয়ে প্রোটিনের গঠন সম্পন্ন করে। এভাবে অ্যামিনো এসিড ছাড়া জীবন প্রায় অসম্ভব বলা যেতে পারে।
অ্যামিনো এসিডের আবিষ্কার
প্রথম অ্যামিনো এসিড আবিষ্কার হয় ১৮০৬ সালে, যখন ফরাসী রসায়নবিদ Louis-Nicolas Vauquelin এবং Pierre Jean Robiquet এসপারাগাস উদ্ভিদ থেকে এসপারাজিন নামের অ্যামিনো এসিডটি আলাদা করেন। এটি ছিল একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার, কারণ অ্যামিনো এসিড প্রোটিন তৈরির মৌলিক উপাদান হিসেবে জীবনের রসায়ন বোঝার পথ খুলে দেয়।
ধূমকেতু ও অ্যামিনো এসিডের সম্পর্ক
ধূমকেতু হচ্ছে এমন এক ধরনের মহাজাগতিক বস্তু যা ধুলো, বরফ এবং গ্যাসের মিশ্রণে তৈরি। এটি সূর্যের নিকটে আসার সময় এর বরফের স্তর গলে যায় এবং গ্যাস ও ধুলো নির্গত হয়, যা একটি উজ্জ্বল কমা ও কখনও কখনও একটি লম্বা লেজ তৈরি করে।
ধূমকেতুর নিউক্লিয়াসে মূলত পাথর, ধূলা, জলীয় বরফ এবং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস যেমন কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন এবং অ্যামোনিয়া থাকে। এছাড়াও, এর মধ্যে মিথানল, সায়ানাইড, ফরমালডিহাইড, ইথানল প্রভৃতি জৈব যৌগও পাওয়া যায়। এই উপাদানগুলো বিশেষ করে জীবনের মূল উপাদান হিসেবে কাজ করতে পারে বলে মনে করা হয়।
বিজ্ঞানীদের মতে, ধূমকেতুর সঙ্গে পৃথিবীর সংঘর্ষের ফলে এই ধরনের জৈব যৌগগুলো পৃথিবীতে আসতে পারে। এর ফলে অ্যামিনো এসিড এবং অন্যান্য জৈব পদার্থ পৃথিবীর প্রাথমিক জীবনের উদ্ভব ঘটাতে সহায়ক হতে পারে।
RUB গবেষণার লক্ষ্য
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে জার্মানির Ruhr-Universität Bochum (RUB) এর গবেষক দল, Prof Dr. Wolfram Sander এর নেতৃত্বে একটি দল মহাকাশের অনুরূপ পরিবেশ তৈরি করে গবেষণা করছে। তারা মহাকাশের শর্তে কীভাবে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে, তা পরীক্ষা করে দেখছেন। তাদের গবেষণার মাধ্যমে নতুন একটি থিওরি উঠে এসেছে যে পৃথিবীর জীবনের উৎস আসলে মহাকাশ থেকেই এসেছে, বিশেষ করে ধূমকেতুর মাধ্যমে।
গবেষণার মূল লক্ষ্য হলো মহাকাশের শীতল তাপমাত্রা এবং অতি বেগুনি রশ্মির প্রভাবে কীভাবে জটিল যৌগ তৈরি হয় তা বোঝা। তারা বিশেষত হাইড্রোক্সিল-অ্যামিন (NH₂–OH) নামে একটি যৌগের ওপর কাজ করছেন, যা অ্যামিনো এসিড তৈরিতে সহায়ক হতে পারে।
গবেষণার পদ্ধতি ও ফলাফল
Yetsedaw Tsegaw নামে একজন পিএইচডি ছাত্র RUB এর ল্যাবে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করেছেন যেখানে ধূমকেতুর বরফ স্থির থাকে এবং সেখানে অ্যামোনিয়া ও অক্সিজেনের মিশ্রণ তৈরি করে উচ্চ শক্তির তরঙ্গ প্রবাহিত করা হয়। এর ফলে হাইড্রোক্সিল-অ্যামিন তৈরি হয় যা প্রাথমিকভাবে দৃশ্যমান হয় না। কিন্তু পর্যাপ্ত তাপ দিলে এটি শনাক্ত করা যায়।
এই গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে মহাকাশে অ্যামিনো এসিডের প্রমাণ মিললে আমরা জীবনের উৎস সম্পর্কে আরও গভীর ধারণা পাবো।
প্রোটিন এবং প্রাণ সৃষ্টির সম্ভাবনা
ধূমকেতুতে যেসব উপাদান পাওয়া যায়, সেগুলো অ্যামিনো এসিডের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে। সুতরাং বিজ্ঞানীরা মনে করছেন যে ধূমকেতুর সঙ্গে পৃথিবীর সংঘর্ষের ফলে এই জৈব যৌগ পৃথিবীতে এসে পড়ে এবং পরে জটিল প্রোটিন তৈরি করে জীবনের উদ্ভব ঘটাতে পারে।
অ্যামিনো এসিডের প্রমাণ পাওয়া গেলে তা মহাকাশে জীবনের উদ্ভব সম্পর্কে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন