জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST) একটি উন্নত মহাকাশ টেলিস্কোপ, যা নাসা, ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ESA), এবং কানাডিয়ান মহাকাশ সংস্থার (CSA) যৌথ প্রকল্প। এটি মহাবিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন গ্যালাক্সি ও নক্ষত্রগুলোর গঠন এবং বিবর্তন পর্যবেক্ষণের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এই টেলিস্কোপটি হাবল স্পেস টেলিস্কোপের উত্তরসূরি এবং এটি ইনফ্রারেড আলো ব্যবহার করে দূরবর্তী মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম।
উদ্দেশ্য:
- মহাবিশ্বের প্রথম গ্যালাক্সি, নক্ষত্র এবং মহাজাগতিক গঠন পর্যবেক্ষণ করা।
- দূরবর্তী গ্রহ এবং তাদের বায়ুমণ্ডল বিশ্লেষণ করা, এবং সেখানে জীবনের সম্ভাবনা অনুসন্ধান করা।
- ব্ল্যাক হোল, ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জির মতো মহাজাগতিক রহস্য উদঘাটন করা।
- মহাবিশ্বের প্রসারণ ও গঠন সম্পর্কিত নতুন তথ্য সংগ্রহ করা।
গঠন:
- প্রধান আয়না: এর প্রধান আয়না ৬.৫ মিটার প্রশস্ত, যা ১৮টি হেক্সাগোনাল সেগমেন্টের মাধ্যমে তৈরি। এটি অত্যন্ত হালকা এবং শক্তিশালীভাবে ডিজাইন করা হয়েছে।
- সানশিল্ড: পাঁচ স্তরের সানশিল্ড, যা টেলিস্কোপকে সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা করে এবং এটিকে শীতল রাখে, যাতে এটি ইনফ্রারেড আলো সঠিকভাবে সংগ্রহ করতে পারে।
- ইনফ্রারেড ডিটেক্টরস: টেলিস্কোপটি মূলত ইনফ্রারেড আলোতে কাজ করে, যা দূরবর্তী গ্যালাক্সি এবং নক্ষত্রগুলোকে পর্যবেক্ষণ করতে সাহায্য করে।
ইতিহাস: জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের প্রথম ধারণা আসে ১৯৯৬ সালে। দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং উন্নয়নের পরে, এটি ২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়। এটি নাসার দ্বিতীয় প্রশাসক জেমস ই. ওয়েবের নামে নামকরণ করা হয়েছে, যিনি ১৯৬০-এর দশকে অ্যাপোলো মিশনের তত্ত্বাবধান করেছিলেন।
মূল পদার্থবিজ্ঞানের কার্যক্রম: জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ ইনফ্রারেড আলোর উপর ভিত্তি করে কাজ করে। মহাজাগতিক বস্তু যেমন গ্যালাক্সি, নক্ষত্র এবং ধূলিকণার মেঘ থেকে নির্গত ইনফ্রারেড রশ্মিগুলো ক্যাপচার করে এটি মহাবিশ্বের দূরবর্তী কোণ পর্যবেক্ষণ করে। ইনফ্রারেড রশ্মি ধূলিকণার মধ্যে দিয়ে যেতে পারে, যা দৃশ্যমান আলোতে অসম্ভব।
আলোর প্রাথমিক প্রক্রিয়া: ইনফ্রারেড আলো এমন একটি রশ্মি, যা মানুষ চোখে দেখতে পায় না, কিন্তু তাপ নির্গমনের মাধ্যমে ধরা যায়। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ এই ইনফ্রারেড আলো সংগ্রহ করতে সক্ষম, যা মহাবিশ্বের প্রাচীনতম গ্যালাক্সি ও নক্ষত্রের বিকিরণ পর্যবেক্ষণ করতে সহায়ক। এই প্রক্রিয়ায় রেডশিফট নামক পদার্থবিজ্ঞানের একটি প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যেখানে দূরবর্তী বস্তু থেকে আসা আলো দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যে প্রসারিত হয় এবং ইনফ্রারেড পরিসরে চলে আসে।
উৎক্ষেপণকাল: ২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর, ফ্রেঞ্চ গায়ানার কৌরু স্পেসপোর্ট থেকে এটি আরিয়ান ৫ রকেটের মাধ্যমে সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়।
বর্তমান অবস্থাঃ বর্তমানে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট ২ (L2) এ স্থিতিশীলভাবে অবস্থান করছে, যা পৃথিবী থেকে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে। এটি নিয়মিতভাবে মহাবিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ছবি ও তথ্য পৃথিবীতে প্রেরণ করছে।
তোলা ছবিগুলো এবং এর পেছনে পদার্থবিজ্ঞান: জেমস ওয়েব ইতিমধ্যে অসাধারণ কিছু ছবি তুলেছে, যার মধ্যে আছে:
- SMACS 0723 (Deep Field): এটি মহাবিশ্বের সবচেয়ে গভীর চিত্রগুলির একটি, যা দূরবর্তী গ্যালাক্সি এবং তাদের বিকিরণকে রেডশিফট প্রক্রিয়ায় ইনফ্রারেড রশ্মির মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।
- কারিনা নেবুলা: এখানে নেবুলার ধূলিকণা এবং গ্যাসের মধ্যে নতুন নক্ষত্রের জন্মের প্রক্রিয়া ধরা পড়েছে।
- স্টেফানস কোয়ান্টেট: এটি পাঁচটি গ্যালাক্সির একটি গ্রুপ, যা একে অপরের সাথে মিথস্ক্রিয়া করছে।
পদার্থবিজ্ঞানের প্রক্রিয়া: এই ছবিগুলো তুলতে মূলত ইনফ্রারেড রশ্মি এবং রেডশিফট প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়েছে। দূরবর্তী বস্তু থেকে আসা আলো মহাবিশ্বের প্রসারণের কারণে প্রসারিত হয়ে ইনফ্রারেড পরিসরে চলে যায়, যা জেমস ওয়েবের ইনফ্রারেড সেন্সর দ্বারা ক্যাপচার করা হয়।
ব্ল্যাক হোল ও গ্রহে পানি এবং এলিয়েন অনুসন্ধান:
- ব্ল্যাক হোল: জেমস ওয়েব ব্ল্যাক হোলের চারপাশের গ্যাস এবং ধূলিকণার গঠন বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হয়েছে।
- পানি: ইতিমধ্যেই জেমস ওয়েব কিছু এক্সোপ্ল্যানেটের বায়ুমণ্ডলে পানির উপস্থিতি শনাক্ত করেছে। উদাহরণস্বরূপ, WASP-96 b নামক একটি এক্সোপ্ল্যানেটে পানির ভরাট অণু পাওয়া গেছে।
- এলিয়েন: এখন পর্যন্ত এলিয়েন বা ভিন্ন কোনও জীবনের সরাসরি প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবে গ্রহগুলোর বায়ুমণ্ডল বিশ্লেষণ এবং জীবনধারণের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা চলছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন