মঙ্গল নয়, শনির চাঁদ টাইটানই আমাদের ভবিষ্যৎ
তানভীর সিদ্দিকী মঈন
চিত্রঃমঙ্গল গ্রহ
সাময়িকী পত্রিকা Journal of
Astrobiology & Outreach তে
জ্যোতির্জৈববিজ্ঞানীরা নাসা এবং স্পেস এক্স এর উদ্দেশ্যে বলেছেন ,"
তাদের উচিৎ মঙ্গলের চাইতে টাইটান বেঁচে নেওয়া। প্রান ধারণের
জন্য পৃথিবীর পর অন্যতম একটি সম্ভাবনাপূর্ণ এই কমলা স্যুপি গ্রহটি। হয়তবা
উপগ্রহটিতে এমন প্রাণের বিকাশ ঘটেছে যাদের পৃথিবীর জীবের সাথে কোন ধরনের মিল নেই
"
চিত্রঃমিথেনের লেক এবং
সাগর
নাসাও তাদের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করেছে,
''সৌরজগতের মধ্যে টাইটান সবচেয়ে পৃথিবী সদৃশ
স্থান। সহজভাবে বললে এটি পৃথিবীর একটি জমাটবাধা জৈবযৌগসমৃদ্ধ ভার্সন । বিলিয়ন বছর
পূর্বে পৃথিবীতে এককোষী জীবেরা অক্সিজেন উৎপাদন করার পূর্বে পৃথিবীর যেমন অবস্থা
ছিল টাইটানের বর্তমান অবস্থা অনেকটা একই"। উল্লেখ্য টাইটানে প্রচুর মিথেন,ইথেন উপস্থিত রয়েছে।
এখনকার
সময়ে এই সৌরজগতে সবচেয়ে আলোচিত এবং
রহস্যময় উপগ্রহ হচ্ছে শনির সবচেয়ে বড় উপগ্রহ । জীঃ টাইটানের কথা বলছি । রোমান
দেবতা Saturn (স্যাটার্ন) এর
নামানুসারে ইংরেজি Saturn নামটি
গ্রহণ করা হয়েছে। হিন্দু পৌরাণিক দেবতা 'শনি'র নামানুসারে এই গ্রহের নামকরণ করা হয়েছে।টাইটান হচ্ছে শনি গ্রহের বৃহত্তম
উপগ্রহ। এটি সৌর জগতের একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ যাতে ঘন বায়ুমণ্ডলের অস্তিত্ব
পাওয়া গেছে। আবার পৃথিবী ছাড়া সৌরজগতের একমাত্র এই বস্তুর পৃষ্ঠেই তরল পদার্থের
সন্ধান মিলেছে।
চিত্রঃক্যাসিনি-হাইগেন্স
ক্যাসিনি-হাইগেন্স অবতরণের পর গ্রহ বিজ্ঞানীরা জানতে পারলেন যে, আমাদের পৃথিবীতে যেমন পানিচক্র বিদ্যমান টাইটানে তেমনি একটি মিথেন চক্র কাযর্কর আছে। এটা অবশ্য অনুমান আর এই অনুমানের উৎস হল টাইটানের ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা triple point মিথেনের এর সমান পৃথিবীতে যা পানির তাপমাত্রার সমান। এই তাপমাত্রায় বস্তু, কঠিন তরল কিংবা গ্যাসীয় এর যে কোন অবস্থায় থাকতে পারে। আর পদার্থের এই তিন অবস্থাই এই উপগ্রহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন করে। টাইটানের জলবায়ু এর পৃষ্ঠে অনেকটা পৃথিবীর মত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, সেখানে বায়ুপ্রবাহ এবং বৃষ্টি দুটোই রয়েছে। পৃথিবী-সদৃশ পৃষ্ঠরূপগুলোর মধ্যে আছে বালিয়াড়ি, নদী, হ্রদ এবং সমুদ্র। তবে সেখানকার সমুদ্র পৃথিবীর মত পানির নয়, বরং মিথেন এবং ইথেনের। বৃষ্টিও হাইড্রোকার্বনের। টাইটানে দেখা যায় উপকূল রেখা, পৃথিবীর মতোই বিভিন্ন ঋতু, মৌসুমি জলবায়ু। এসব কারণে টাইটানকে আদিম পৃথিবীর সাথে তুলনা করা হয়, যদিও পৃথিবীর তুলনায় তার তাপমাত্রা অনেক কম।এখানে এমন কিছু রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া গেছে যা প্রানের উৎস হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করে । তাই বিজ্ঞানিরা টাইটানকে চাঁদ না ভেবে গবেষণার বিশাল ভাণ্ডার ভাবা শুরু করেছে ।
টাইটানে
উপস্থিত জৈবযৌগগুলি পেট্রোলিয়াম জাতীয়। ধারনা করা হয় পৃথিবীর সব খনিতে মজুদকৃত
পেট্রোলিয়াম এবং গ্যাসের পরিমাণের চাইতে কয়েকশ গুন টাইটানে উপস্থিত রয়েছে। মঙ্গলে
একমাত্র সৌরশক্তির উপর ভরসা করতে হবে। কিন্তু টাইটানে বিভিন্ন ধরনের শক্তির উৎস
বিদ্যমান আছে। উপগ্রহটিতে সৌর,বায়ু, কেমিক্যাল,নিউক্লিয়ার,জিওথার্মাল,হাইড্রোপাওয়ার শক্তি বাবহারের সুযোগ রয়েছে। টাইটানে বায়ুর
শক্তিশালী প্রবাহ থাকায় সহজের বায়ুশক্তি পাওয়া যাবে।টাইটানের অভিকর্ষজ ত্বরণ কম
হওয়ায় টারবাইন ঘুরতেও কম বেগ পেতে হবে। আবার টাইটানে তরলের প্রবাহমান লেক থাকায়
হাইড্রোপাওয়ার শক্তিরও সম্ভাবনা রয়েছে।উপগ্রহটিতে পৃথিবীতে আপতিত আলো ও তাপের
মাত্র ১০ শতাংশ পতিত হলেও তা যথেষ্ট শক্তি যোগান দিতে পারবে। আবার এর তরলের লেকের
গভীর তলদেশ নিউক্লিয়শক্তি উৎপাদনের জন্যে আদর্শ।
চিত্রঃরাসায়নিক উপাদান
টাইটান
সৌরজগতের একমাত্র উপগ্রহ যার বায়ুমণ্ডল আছে। বায়ুচাপ পৃথিবীর চেয়ে একটু বেশি,
পৃথিবী থেকে প্রায় ৬০% . বেশি। টাইটান আকারে ছোট হওয়ায়
অভিকর্ষ বল কম, তাই বায়ুমণ্ডল
প্রায় ৬০০ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত। বায়ুমণ্ডলের প্রধান উপাদান নাইট্রোজেন ৯৫ ভাগ,
শতকরা ৫ ভাগ মিথেন ও সামান্য অন্যান্য কার্বন যৌগ রয়েছে।
বায়ুমণ্ডলের উপরিভাগে মিথেন এবং নাইট্রোজেন সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মি এবং শনির
চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে ভেঙ্গে যায়। এই ভেঙ্গে যাওয়া পরমাণু ( মিথেন ও
নাইট্রোজেন) আবার পুনর্গঠন করে বিভিন্ন জৈব - যৌগ গঠন করে।
চিত্রঃ Atacama Large
Millimeter/submillimeter Array (ALMA)
বিজ্ঞানিরা টাইটানে ঋনাক্তক চার্জ বিশিষ্ট কার্বন আয়ন খুজে পেয়েছে । আর আমরা জানি এই ঋনাক্তক চার্জ বিশিষ্ট কার্বন আয়ন থেকে অনেক জটিল যৌগ তৈরি করা সম্ভব ।সম্প্রতি নাসার একটি গবেষণা দল চিলির Atacama Large Millimeter/submillimeter Array (ALMA) তে বসে এমন কিছু রাসায়নিক পদার্থ আবিষ্কার করেছে যা টাইটানে প্রানের উৎস আছে তার দিকে সন্দেহের তীর ছুড়ে দিয়েছে । আর এটি হচ্ছে এক্রাইনলিট্রাইল । এই গবেষণা পত্রটির টাইটেল ছিল ALMA detection and astro-biological potential of vinyl cyanide on Titan । এটি Science Advances এ প্রকাশিত হয়েছে ২৮ জুলাই । এতে বলা হয়েছে যে টাইটান উপগ্রহে প্রচুর পরিমান এক্রাইনলিট্রাইল রয়েছে । বিশেষ করে টাইটানের বায়ুমণ্ডলের স্ট্রাটোস্ফিয়ারে এটি প্রচুর রয়েছে ।
চিত্রঃএক্রাইনলিট্রাইল
নাসা গডার্ড সেন্টার ফর
এস্ট্রোবায়োলজী এর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে । গবেষণা পত্রটি লিখেন
মরিন পামার নামক একজন গবেষক । এই
গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে যে তারা এমন কিছু পেয়েছি যাতে এটা প্রমাণিত হয় যে টাইটানের বায়ুমণ্ডলে এক্রাইনলিট্রাইল রয়েছে এবং তারা মনে করছে
টাইটানে এমন কিছু আছে যা এই এক্রাইনলিট্রাইল কে যোগান দিচ্ছে । এক্রাইনলিট্রাইল
- এটি ভিনাইল সায়ানাইড নামেও পরিচিত । পৃথিবীতে এটি দ্বারা প্লাস্টিক তৈরী করা হয়
। পূর্বে ধারনা করা হয়েছিলো যে টাইটানের বায়ুমণ্ডলে এক্রাইনলিট্রাইল থাকতে পারে ।
কিন্তু বিজ্ঞান চায় প্রমান । তখন বিজ্ঞানীরা অতটা নিশ্চিত ছিল না এই ব্যাপারে ।
সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞানীরা টাইটানের সমৃদ্ধ জৈব পরিবেশের মধ্যে প্রাণীদের জন্য এটি
ভিত্তি হতে পারে এমন সম্ভাবনা দেখছেন ।
কারন এই সমৃদ্ধ জৈব পরিবেশে - কার্বন, হাইড্রোজেন এবং নাইট্রোজেন এর ক্রমাগত সরবরাহ হচ্ছে ।
চিত্রঃমিথেন লেক
2015
সালে পরিচালিত একটি গবেষণায় উপর ভিত্তি করে , কার্নেলের এক দল বিজ্ঞানী
টাইটানের অপ্রতিকুল পরিবেশে জৈব কোষ গঠন করতে পারে কিনা তা
নির্ধারণ করতে চেয়েছিল ।ওই গবেষণা পত্রে উল্লেখ্য ছিল যে ,চাঁদের পৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা -১৭৯সেঃ এবং এই
পরিবেশে নাইট্রোজেন , হাইড্রো-কার্বন , লিপিড
চিত্রঃ বরফের পর্বত
আনবিক সিমুলেশনের পরে দলটি গবেষণা করে বুঝতে পারে যে , ছোট জৈব নাইট্রোজেন যৌগ থেকে শীট তৈরি করা সম্ভব যা কিনা কোষ ঝিল্লীর মত কাজ করে ।তারা গবেষণা করে আরও বুঝতে পারে যে এই শীট হোল মাইক্রোস্কোপিক গোলক গঠন করতে পারে । তারা এই শীটগুলোর নাম দেন অ্যাজোটোসমস এবং এই শীটগুলোর মধ্যে প্রধান রাসায়নিক পদার্থ হচ্ছে এক্রাইনলিট্রাইল । যদি টাইটান নামক উপগ্রহে কোন জৈব যৌগ তরল মিথেন এবং অনেক বেশি ঠাণ্ডায় টিকে থাকতে পারে তবেই প্রানের উৎস পাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে ।
এ বিষয়ে গডার্ড সেন্টার ফর এস্ট্রোবায়োলজী ডিরেক্টর মাইকেল মুম্মা বলেনঃ
“কোন কিছুকে অভ্যন্তরীণ পরিবেশ থেকে পৃথক করার জন্য একটি স্থিতিশীল ঝিল্লি গঠন করার ক্ষমতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । কারণ এটি রাসায়নিক পদার্থগুলো ধারন করে এবং রাসায়নিক পদার্থগুলোর মধ্যে দীর্ঘ স্থায়ী সংযোগ রাখতে ভূমিকা রাখে । আর এই ঝিল্লী যদি ভিনাইল সায়ানাইড দিয়ে তৈরী হয় তাহলে শনির টাইটান উপগ্রহে এটি হবে প্রানের উৎস পাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ ধাপ” ।
শনি গ্রহের চুম্বক্ষেত্র থেকে পাওয়া শক্তি এবং সূর্যের আলো থেকে পাওয়া শক্তি উভয় শক্তির মাধ্যমে কার্বন , হাইড্রোজেন এবং নাইট্রোজেন পরস্পর বন্ধনে আবদ্ধ হয় । এমনকি একই উপায়ে তৈরি হয়ে ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টির ফোটা আকারে টাইটানের পৃষ্ঠে পতিত হয় । এর সর্ববৃহৎ মিথেন লেক হচ্ছে লিজা মারে । দলটি এই লেকে কি পরিমান এক্রাইনলিট্রাইল জমা আছে তা নিয়ে গবেষণা করেছিল ।তারা হিসেব করে দেখেছে যে প্রতি একক আয়তনে লিজা মারে লেকে প্রায় ১০০০০০০০ অজোটোসোম রয়েছে । এখানকার পানিতে পৃথিবীর উপকূলীয় অঞ্চলের মতই ১০ গুন ব্যাকটেরিয়া রয়েছে । মার্টিন কোর্ডিনার এই গবেষণাপত্রের একজন জ্যেষ্ঠ লেখক ।
তিনি বলেন যে “সৌরজগতে প্রানের উৎস সন্ধানের ক্ষেত্রে এই উপাদানগুলোর আবিস্কার অনেক বেশি অনুপ্রেরনা জোগাবে” ।
এই গবেষণাটি অত্যন্ত দূর-কল্পনাভিত্তিক । গবেষণাটি যেহেতু পৃথিবীতে বসে করা হয়েছে । সুতরাং এটি থেওরিটিকালী প্রমাণিত । তাই একে বলা হয়েছে দূর-কল্পনাভিত্তিক । কিন্তু বিজ্ঞানিরা দেখিয়েছেন যে সৌরজগতের যেসব স্থানে সূর্যের আলো যেতে পারে সে সব স্থানে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে জীবনের অস্তিত্ব রয়েছে । এই গবেষণাটি সৌরজগতের বাইরে প্রানের উৎস খোঁজার ব্যাপারে দারুন প্রভাব ফেলতে পারবে । বিজ্ঞানীরা একবার যদি প্রমান করে দেয় দিত যে জীবনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য গরম তাপমাত্রা এবং তরল অবস্থায় পানির দরকার নাই তাহলেই অপরিমেয় সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে ।
আগামী
কয়েক দশক ধরে টাইটানের অভিমুখে বিভিন্ন অভিযানের পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে ।টাইটানের বায়ুমণ্ডল এবং পৃষ্ঠের পরিবেশ অনুসন্ধান
করার জন্য এর মিথেন লেককে টার্গেট করা হয়েছে । এই ধরনের গবেষণা করার
উদ্দেশ্যে মিথেন লেকে সাবমেরিন থেকে ড্রোন
এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্র পাঠানোর পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে । আশা
করা হচ্ছে বিজ্ঞানীরা সৌরজগৎ কিভাবে তৈরী
হয়েছে সে সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লাভ করতে পারবে । সেই সাথে জীবনের সম্পূর্ণ নতুন যে রূপ তাও
আবিষ্কার করতে পারবে বিজ্ঞানীরা । এটা সত্যি খুব বিস্ময়কর ।
সূত্রঃ seeker.com, space.com ,
Wikipedia , universetoday.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন