জল জীবাণুমুক্ত করার জন্য ব্যবহৃত রাসায়নিকগুলো যখন পানির প্রাকৃতিক উপাদানগুলোর সাথে প্রতিক্রিয়া করে তখন যে ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ গঠিত হয়, সেগুলোকে ডিসইনফেকশন বাইপ্রোডাক্টস (Disinfection Byproducts) বলা হয়। এই বাইপ্রোডাক্টগুলো মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে।
কাজের প্রক্রিয়া (Mechanism of Action)
ডিসইনফেকশন বাইপ্রোডাক্টস (DBPs) গঠনের প্রক্রিয়াটি মূলত পানির মধ্যে থাকা জীবাণুনাশক পদার্থ এবং প্রাকৃতিক জৈব পদার্থের (Natural Organic Matter - NOM) মধ্যে রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার ফলাফল। এই প্রক্রিয়াটি বিভিন্ন ধাপ এবং উপাদানের উপর নির্ভরশীল। নিচে এই কাজের প্রক্রিয়াটি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হলো:
১. জীবাণুনাশক প্রয়োগ:
- জীবাণুনাশক পদার্থের ব্যবহার: পানিকে জীবাণুমুক্ত করতে সাধারণত ক্লোরিন, ক্লোরামাইন, ওজোন বা ক্লোরাইন ডাইঅক্সাইডের মতো জীবাণুনাশক ব্যবহার করা হয়।
- উদ্দেশ্য: এই জীবাণুনাশক পদার্থগুলি পানির মধ্যে থাকা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক মাইক্রোঅর্গানিজম ধ্বংস করে।
২. প্রাকৃতিক জৈব পদার্থের উপস্থিতি:
- উৎস: পানির উৎসে (যেমন নদী, হ্রদ, ভূগর্ভস্থ জল) প্রাকৃতিকভাবে উপস্থিত জৈব পদার্থ থাকে, যেমন হিউমিক অ্যাসিড, ফালভিক অ্যাসিড, এবং অন্যান্য দ্রবণীয় জৈব যৌগ।
- বৈশিষ্ট্য: এই জৈব পদার্থগুলি মূলত পচনশীল উদ্ভিদ ও প্রাণীজ উপাদানের থেকে উৎপন্ন।
৩. রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া:
- প্রতিক্রিয়ার শুরু: জীবাণুনাশক পদার্থ পানির জৈব পদার্থের সাথে যোগাযোগ করলে রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়।
- প্রতিক্রিয়ার ধরন: অক্সিডেশন, হ্যালোজেনেশন বা অন্যান্য জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়া ঘটে।
- ক্লোরিনের ক্ষেত্রে: ক্লোরিন একটি শক্তিশালী অক্সিডাইজার এবং হ্যালোজেন, যা জৈব পদার্থের সাথে যুক্ত হয়ে ক্লোরিনেটেড যৌগ গঠন করে।
৪. ডিসইনফেকশন বাইপ্রোডাক্টসের গঠন:
- বিভিন্ন ধরনের ডিবিপি: প্রতিক্রিয়ার ফলে ট্রাইহ্যালোমিথেনস (THMs), হ্যালোএসিটিক অ্যাসিডস (HAAs), হ্যালোনাইট্রোমিথেনস, ক্লোরাইটস, ব্রোমেটস ইত্যাদি গঠিত হয়।
- উপাদানের প্রভাব: পানিতে উপস্থিত ব্রোমাইড বা আইওডাইড আয়ন থাকলে, ব্রোমিনেটেড বা আইওডিনেটেড ডিবিপি গঠনের সম্ভাবনা বাড়ে, যা আরও ক্ষতিকারক হতে পারে।
প্রতিক্রিয়ার উদাহরণ:
ক্লোরিন এবং জৈব পদার্থ:এখানে, NOM হলো প্রাকৃতিক জৈব পদার্থ, যা ক্লোরিনের সাথে প্রতিক্রিয়া করে হ্যালোজেনেটেড যৌগ (যেমন THMs) গঠন করে।
ওজোন এবং জৈব পদার্থ:
ওজোনের সাথে প্রতিক্রিয়ায় জৈব পদার্থ অক্সিডাইজ হয়ে ছোট ছোট অণু গঠন করে।
ডিবিপি গঠনে প্রভাবিত করে এমন কারণসমূহ:
- তাপমাত্রা: উচ্চ তাপমাত্রায় প্রতিক্রিয়ার গতি বৃদ্ধি পায়, ফলে ডিবিপি গঠনের হার বাড়ে।
- pH মাত্রা: pH মান বৃদ্ধি পেলে কিছু ডিবিপি (যেমন THMs) বেশি গঠিত হয়, আবার pH হ্রাস পেলে অন্য ডিবিপি বেশি গঠিত হতে পারে।
- জীবাণুনাশকের মাত্রা ও ধরন: জীবাণুনাশকের কনসেনট্রেশন ও প্রকারভেদ ডিবিপি গঠনে সরাসরি প্রভাব ফেলে।
- প্রতিক্রিয়া সময়: জীবাণুনাশক এবং জৈব পদার্থের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সময় যত বেশি হবে, ডিবিপি তত বেশি গঠিত হবে।
- জৈব পদার্থের ঘনত্ব: পানিতে NOM এর পরিমাণ বেশি থাকলে ডিবিপি গঠনের সম্ভাবনা বাড়ে।
নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ:
- প্রাক-চিকিৎসা: জীবাণুনাশক প্রয়োগের আগে পানির মধ্যে থেকে জৈব পদার্থ অপসারণের জন্য কোগুলেশন, ফ্লোকুলেশন এবং সেডিমেন্টেশন প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়।
- জীবাণুনাশকের বিকল্প ব্যবহার: ক্লোরিনের পরিবর্তে ক্লোরামাইন ব্যবহার করা যেতে পারে, যা কম ডিবিপি গঠন করে।
- অ্যাডভান্সড অক্সিডেশন প্রক্রিয়া: UV বিকিরণ বা ওজোনের সাথে হাইড্রোজেন পারক্সাইড ব্যবহার করে জৈব পদার্থ অক্সিডাইজ করা।
- গ্রানুলার অ্যাক্টিভেটেড কার্বন ফিল্টারেশন: এই পদ্ধতিতে জৈব পদার্থ শোষণ করে অপসারণ করা হয়।
- ডিবিপি গঠনের নিরীক্ষণ: নিয়মিতভাবে পানির গুণগত মান পরীক্ষা করে ডিবিপি স্তর নির্ধারণ করা।
স্বাস্থ্যগত প্রভাব:
ডিবিপি গঠনের ফলে মানবস্বাস্থ্যের উপর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে, যেমন ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি, প্রজনন সমস্যা, এবং বিকাশগত জটিলতা। তাই, ডিবিপি গঠনের প্রক্রিয়া বোঝা এবং তা নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন