কোয়ান্টাম টানেলিং
কোয়ান্টাম টানেলিং কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটি অদ্ভুত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যেখানে একটি কণা, যেমন একটি ইলেকট্রন, শক্তির বাধা (পোটেনশিয়াল ব্যারিয়ার) অতিক্রম করতে সক্ষম হয়, যদিও তার শক্তি সেই বাধা পার হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। এটি কোয়ান্টাম তত্ত্বের একটি অবিশ্বাস্য গুণ, যেখানে কণার অবস্থান বা শক্তি নির্দিষ্টভাবে স্থির না হয়ে তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে, যার কারণে কণা কিছু পরিমাণে পোটেনশিয়াল ব্যারিয়ারের ভেতরে প্রবাহিত হতে পারে এবং পরে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে।
পোটেনশিয়াল ব্যারিয়ার
পোটেনশিয়াল ব্যারিয়ার হল একটি শক্তির বাধা যা একটি কণাকে সীমাবদ্ধ করতে পারে। যেমন, যদি একটি কণার শক্তি কম থাকে এবং একটি পোটেনশিয়াল ব্যারিয়ারের সামনে আসে, তাহলে সাধারণভাবে সেই কণা ব্যারিয়ারটি অতিক্রম করতে পারবে না। তবে কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুসারে, কণার তরঙ্গ ফাংশন কিছু পরিমাণে ব্যারিয়ারের ভিতর প্রবাহিত হতে পারে, যা টানেলিং ইফেক্ট তৈরি করে।
কোয়ান্টাম টানেলিং এবং ওয়েভ ফাংশন
কোয়ান্টাম মেকানিক্সে, কণার অবস্থান এবং গতি নির্দিষ্টভাবে জানা সম্ভব নয়, এর পরিবর্তে কণার ওয়েভ ফাংশন (ψ) দ্বারা তার অবস্থান এবং সম্ভাবনা বর্ণনা করা হয়। যখন কণা একটি পোটেনশিয়াল ব্যারিয়ারের সম্মুখীন হয়, তখন তার ওয়েভ ফাংশন ব্যারিয়ারের ভেতরেও কিছু পরিমাণে প্রবাহিত হতে পারে, এমনকি যদি তার শক্তি ব্যারিয়ারের উচ্চতা থেকে কম হয়। এর ফলে, কণা ব্যারিয়ারটি "টানেল" করতে পারে।
কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের গাণিতিক ব্যাখ্যা:
১. শ্রেডিংগার সমীকরণ:
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভিত্তি হল শ্রেডিংগার সমীকরণ যা কণার তরঙ্গ ফাংশন (ψ) বর্ণনা করে। এর একটি সাধারণ রূপ হলো:
এখানে:
-
হলো হ্যামিলটনিয়ান অপারেটর (যা কণার শক্তি বর্ণনা করে)।
-
হলো তরঙ্গ ফাংশন (যা কণার অবস্থান বা গতি বর্ণনা করে)।
-
হলো কণার শক্তি।
২. পোটেনশিয়াল ব্যারিয়ার এবং টানেলিং সম্ভাবনা:
ধরা যাক, একটি কণা পোটেনশিয়াল ব্যারিয়ারের সম্মুখীন হয়েছে যার উচ্চতা । ব্যারিয়ারের বাইরে কণার শক্তি এবং ব্যারিয়ারের ভিতরে (যেখানে হলো কণার শক্তি এবং হলো ব্যারিয়ারের উচ্চতা)। এই অবস্থায়, কণার তরঙ্গ ফাংশন ব্যারিয়ারের ভিতরে কিছু পরিমাণে “টানেল” করতে পারে।
শ্রেডিংগার সমীকরণের সমাধান অনুযায়ী, ব্যারিয়ারের ভিতরে তরঙ্গ ফাংশন নিম্নরূপ হবে:
এখানে:
-
(এখানে হলো কণার ভর, হলো ব্যারিয়ারের উচ্চতা, হলো কণার শক্তি এবং হলো হবার্টের কনস্ট্যান্ট)।
-
হলো প্রথম অবস্থার তরঙ্গ ফাংশনের মান।
-
হলো ব্যারিয়ারের ভিতরে কণার অবস্থান।
এই সমীকরণে দেখা যাচ্ছে যে, কণার তরঙ্গ ফাংশন ব্যারিয়ারের ভিতরে ধীরে ধীরে কমে যায়, তবে একদম শূন্য হয়ে যায় না। এর মানে, কণার কিছু সম্ভাবনা ব্যারিয়ারের ওপারে পৌঁছানোর থাকে, এবং সেই কণা ব্যারিয়ার অতিক্রম করতে পারে।
৩. টানেলিং সম্ভাবনা:
ব্যারিয়ারের অন্য পাশে পৌঁছানোর সম্ভাবনা নির্ভর করে তরঙ্গ ফাংশনের আপেক্ষিক "ড্রপ" বা হ্রাসের উপর। এর গাণিতিক হিসাব হলো, ব্যারিয়ারের ভিতরের তরঙ্গ ফাংশনের কমার হার অনুযায়ী, টানেলিং সম্ভাবনা কিছু পরিমাণে নির্ধারণ করা যায়।
টানেলিং সম্ভাবনা হলো:
এখানে:
-
হলো পোটেনশিয়াল ব্যারিয়ারের প্রস্থ।
-
হলো ব্যারিয়ারের ভিতরে তরঙ্গ ফাংশনের পতনের হার।
টানেলিং ইফেক্টের উদাহরণ:
-
আলফা বিকিরণ (Alpha Decay): একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হলো আলফা বিকিরণ, যেখানে একটি অস্থির পারমাণবিক নিউক্লিয়াস আলফা কণিকা (He²⁺) নির্গত করে। এই প্রক্রিয়ায় কণা একটি শক্তিশালী পোটেনশিয়াল ব্যারিয়ারের সামনে এসে টানেলিং এর মাধ্যমে বেরিয়ে আসে। আলফা কণিকা ব্যারিয়ারের ভেতর দিয়ে টানেল করে এবং নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে যায়।
-
সেমিকন্ডাক্টর ডিভাইস: সেমিকন্ডাক্টর ডিভাইসে কোয়ান্টাম টানেলিং একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ, ট্রানজিস্টরের ক্ষেত্রে, যখন ইলেকট্রনের শক্তি খুব কম থাকে, তবে সেগুলি পোটেনশিয়াল ব্যারিয়ার অতিক্রম করতে পারে এবং সেমিকন্ডাক্টর চিপে সিগন্যাল পাঠাতে পারে।
-
সান্ট্রি-কম্পিউটিং (Quantum Computing): কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এও টানেলিং প্রক্রিয়া ব্যবহৃত হয়। এটি কণার এক অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানে স্থানান্তর করার জন্য ব্যবহৃত হয়, যেমন কোয়ান্টাম বিট (qubit) এর মাধ্যমে। এই প্রযুক্তি কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের মাধ্যমে আরো দ্রুত এবং দক্ষ কম্পিউটিং করার সক্ষমতা প্রদান করে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন